আপনি কি জানেন, আখেরি চাহার সোম্বা কি? ২০২৫
আপনি কি জানেন, আখেরি চাহার সোম্বা কি? ২০২৫।আসসালামু আলাইকুম। আপনারা অনেকেই আখেরি চাহার সোম্বা, আখেরি চাহার সোম্বা কি এবং কেন, আখেরি চাহার সোম্বা ফজিলত এবং আখেরি চাহার সোম্বা কত তারিখ ইত্যাদি বিষয়ে সম্পর্কে জানতে চান। একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে সকলেরই জানা উচিত আখেরি চাহার সোম্বা কি?
![]() |
আখেরি-চাহার-সোম্বা। ছবি - এআই |
আরবি শব্দ 'আখেরি' অর্থ শেষ, ফারসি শব্দ 'চাহর' অর্থ সফর মাস এবং ফারসি শব্দ 'সোম্বা' অর্থ বুধবার অর্থাৎ আখেরি চাহার সোম্বা এর অর্থ দাঁড়ায় সফর মাসের শেষ বুধবার। সারা বিশ্বে মুসলমান সম্প্রদায় 'আখেরি চাহার সোম্বা' দিনটিকে 'শুকরিয়া দিবস' হিসেবে পালন করে থাকেন। আজকে আমরা আখেরি চাহার সোম্বা কি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবো।
আখেরি চাহার সোম্বা কি
আখেরি চাহার সোম্বা কি? সারা বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিকট এই দিনটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ দিবস। প্রতি বছর আরবি হিজরী সনের দ্বিতীয় মাস সফর মাসের শেষ বুধবার মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাবান দিবস হিসেবে আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হয়। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইরানের মুসলিম ধর্মালম্বীদের নিকট এটি একটি পবিত্র দিবস। আরবি ১১ হিজরির শুরুতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে নামাজের ইমামতি পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। আরবি দ্বিতীয় মাস সফর মাসের ২৮ তারিখ তিনি সকালে হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং গোসল করেন। তারপর তিনি শেষবারের মতো নামাজের ইমামতি করেন। দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার অর্থাৎ 'আখেরি চাহার সোম্বা'। (সূত্র: Wikipedia)
আখেরি চাহার সোম্বা কেন পালিত হয়
আখেরি চাহার সোম্বা কেন পালিত হয়? বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ মানব জাতির জন্য অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয়। মহান আল্লাহ তায়ালাকে পেতে হলে অবশ্যই তাঁর প্রিয় হাবিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসতে হবে এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। কেননা নবী প্রেম প্রত্যেক মু'মিনের জন্য আদর্শ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা সকল কিছু সাহাবায়ে কেরামকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনের ৩৩ নম্বর সূরা আল আহযাব এ উল্লেখ করেছেন,
আরবি উচ্চারণ:النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
বাংলা উচ্চারণ:
আন্নাবিয়্যুঁ আওলা বিআল মু'মিনিন মিন আনফুসিহীম ওয়াআজ জুহু উম্মা হাতুহুম।
বাংলা অর্থ:
নবী মু'মিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা। (সূরা আল আহযাব: আয়াত নং ৬)
আরো পড়ুন: সালাতুত তাসবিহ নামাজের সঠিক নিয়ম পদ্ধতি।
মহান আল্লাহ তা'আলা আল কোরআনের উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে নবী-রাসূলগণের মূল্যায়ন নিজেদের চেয়েও বেশি মর্যাদা বুঝাতে চেয়েছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হলে সাহাবায়ে কেরাম সহ সকল মুসলিম ব্যথিত এবং কাতর হবে এটাই স্বাভাবিক। আরো এক হাদীসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুরুত্ব এবং মর্যাদা জানতে পারা যায়। নিচে হাদীসটি উল্লেখ করা হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সব মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় না হই। (সহিহ বুখারী, প্রথম খন্ড, ঈমান অধ্যায়: হাদিস নং ১৩-১৪ ই. ফা.)
আখেরি চাহার সোম্বা তাৎপর্য ও ফজিলত
মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে ৬৩ বছর বেঁচে ছিলেন। বিধর্মী ও অবিশ্বাসীদের শত অত্যাচার ও নির্যাতনের মাঝেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের অমীয় বাণী ছড়িয়ে দিতে রাসুলুল্লাহ সাঃ ছিলেন অত্যন্ত অটল এবং অবিচল। কিন্তু পার্থিব নিয়ম অনুসারে সকলকে একদিন মহান আল্লাহর দরবারে ফিরে যেতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতার দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাক তার সীরাতে রাসূলুল্লাহ সাঃ গ্রন্থে দাবি করেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বাকিউল গারকাদের কবরস্থান থেকে ফিরে প্রচন্ড শিরপীড়া বা মাথাব্যথা রোগে আক্রান্ত হন। অন্যদিকে সীরাতে রাসূলুল্লাহ সাঃ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনে হিসাম তার সিরাতুন্নবী সাঃ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মুহাম্মদ সাঃ তাঁর অন্তিম যাত্রায় প্রচন্ড মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। মূলত ওই মাথাব্যথা এতটা মারাত্মক ছিল যে তিনি তাঁর অন্তিম যাত্রার অধিকাংশ সময় অজ্ঞান ছিলেন। একটু সুস্থ হলেও আবার তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
![]() |
আখেরি-চাহার-সোম্বা। ছবি - এআই |
রাসূলুল্লাহ সাঃ অসুস্থ হলে আবিসিনিয়া থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানো হলেও অসুস্থতার কোন পরিবর্তন হয়নি। কিছুক্ষণ সুস্থ হলেও পরবর্তীতে আবার তিনি জ্ঞান হারাতেন। এ সময় রাসূলুল্লাহর পরিবার সহ সাহাবায়ে কেরামগণ তাঁর বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এলো এবং তিনি কিছুটা সুস্থতা অনুভব করলেন। তারপর সাতটি কূপের পানি দিয়ে তাঁকে গোসল করানো হলো। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহুর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা রাঃ ও দুই নাতি হাসান-হোসাইন রাঃ কে ডেকে পাঠালেন। তারপর তাদের সাথে নিয়ে দুপুরের খাবার খেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার ঘটনায় তাঁর পরিবারের সদস্য ও সাহাবাগন আনন্দে আত্মহারা হন।
আরো পড়ুন: র দিয়ে ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ।
মদিনাবাসী এই খবর জানতে পেরে দলে দলে তাঁকে দেখতে আসেন। খুশিতে সকলে তারা নফল নামাজ আদায় করেন এবং গরিব দুঃখীদের মাঝে সাধ্যমত দান-সদকা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রোগ মুক্তিতে সাহাবায়ে কেরামগণ কেউ কেউ খুশিতে নিজেদের দাসমুক্ত করেন এবং নগদ অর্থসহ উট দান করেন। যতদূর জানা যায়, হযরত আবু বকর রাঃ ৫ হাজার দিরহাম, হযরত ওমর রাঃ ৭ হাজার দিরহাম, হযরত ওসমান রাঃ ১০ হাজার দিরহাম, হযরত আলী রাঃ ৩ হাজার দিরহাম মুদ্রা এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর পথে দান করেছিলেন।
আরো পড়ুন: রোগমুক্তির দোয়া।
তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন শনিবার, কেউ বলেন বুধবার এবং কেউ বলেন সোমবার তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন। আবার কতদিনের জন্য অসুস্থ হয়েছিলেন সে বিষয়েও কেউ কেউ বলেন ১০ দিন, কেউ বলেন ১২ দিন, কেউ বলেন ১৩ দিন এবং কেউ বলেন ১৪ দিন। এরপর তিনি ওফাত (ইন্তেকাল) লাভ করেন। (জারকানি/শারহুল মাওয়াহিব ১২ /৮৩; কাসতালানি, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ, আল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া: ৩ /৩৮৩)
আখেরি চাহার সোম্বা কত তারিখ?
আখেরি চাহার সোম্বা কত তারিখ? আখেরি চাহার সোম্বা বলতে সফর মাসের চতুর্থ বা শেষ বুধবারকে বলা হয়। সেই হিসেবে এ বছর আরবি ১৪৪৭ হিজরীর দ্বিতীয় মাস সফর এর শেষ বুধবার হল ২৫ তারিখ। সুতরাং এ বছর ইংরেজি ২০২৫ সালের আখেরি চাহার সোম্বা হল আগস্ট মাসের ২০ তারিখ বুধবার। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ রাখার পাশাপাশি অফিস আদালতে ঐচ্ছিক ভাবে ছুটির দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আশা করি, আখেরি চাহার সোম্বা কত তারিখ তা ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পেরেছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে আখেরি চাহার সোম্বা
ইসলামে শুধুমাত্র দুটি দিবস ব্যতীত অন্য তৃতীয় কোন দিবস পালন করা থেকে বিরত করেছেন। একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি হলো ঈদুল আযহা।
হযরত আনাস রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন যে, মদিনা বাসীরা দুটি ঈদ (আনন্দের দিন) পালন করছে। তা দেখে রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, জাহিলিয়াতের যুগে তোমাদের দুটি দিন ছিল যাতে তোমরা খেলাধুলা, আনন্দ ফুর্তি করতে এখন ওই দিনগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদেরকে দুটি উত্তম দিন প্রদান করেছেন, একটি ঈদুল ফিতর ও অন্যটি ঈদুল আজহার দিন। (আবু দাউদ: হাদিস নং ১০০৪; নাসায়ী: হাদিস নং ১৫৫৫)
আবার জন্মদিন কে কেন্দ্র করে কখনো কখনো অপচয় এবং অপব্যয় করতে দেখা যায়। ইসলামে অপচয় এবং অপব্যয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অপচয় নিষিদ্ধ করে মহান আল্লাহতালা আল কুরআনের সূরা আরাফে উল্লেখ করেন, তোমরা আহার কর ও পান কর কিন্তু অপচয় করো না। (সূরা আরাফ: আয়াত নং ৩১)
আখেরি চাহার সোম্বা উদযাপন
ইসলামী ধর্ম চিন্তাবিদদের মতে এই দিবসটি পালন করা নিয়ে মতভেদ থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন অজু-গোসল করে নফল নামাজ আদায় ও দান-সদকার মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করে থাকেন। দিবসটি মূলত 'শুকরিয়া দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাঃ এর অসুস্থতার সঠিক দিনক্ষণ স্পষ্ট করে কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আবার নবীজি সাঃ এর মৃত্যুর পর কোন সাহাবীও এই দিবস পালন করতে না, তাই এই দিবস পালনে তারা নিরুৎসাহিত করেন। তবে কেউ যদি নিজের থেকে ভালো মনে করে ইবাদতের পদ্ধতি তৈরি করে সওয়াবের আশায় এই দিনটি পালন করে তবে সেটা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, "কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত"। (সহিহ বুখারী: হাদিস নং ২৬৯৭; মুসলিম: হাদিস নং ১৭১৮)
আরো পড়ুন: আউয়াবিন নামাজের ফজিলতসর্বশেষ কথা - আখেরি চাহার সোম্বা কি?
সম্মানিত পাঠক, এতক্ষণ আমরা আখেরি চাহার সোম্বা কি? সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি আখেরি চাহার সোম্বা কি? সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং বুঝতে পেরেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের কে বিদআত থেকে মুক্তি দিন এবং ইসলামের সঠিক পথে থেকে জীবন অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন -আমীন। লেখাটি পড়ে আপনি উপকৃত হয়ে থাকলে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো যেন আপনার বন্ধু-বান্ধবও উপকৃত হতে পারেন। লেখার মাধ্যমে ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। তবে কমেন্টের মাধ্যমে জানালে অধিক খুশি হব। লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url